আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে প্রকাশ্যে নিজ নিজ জেলার দলীয় সংসদ সদস্য ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষনেতাদের নামে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন দলটির জেলা পর্যায়ের নেতারা। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সহযোগী সংগঠনে স্থান দেওয়া, জেলা পর্যায়ে দলীয় কর্মসূচিতে অনুপস্থিতিসহ নানা অভিযোগ করেছেন তারা।
তাদের বক্তব্যে নিজ নিজ জেলায় দলের ভেতরে কোন্দল ও ক্ষোভের বার্তা স্পষ্ট। গতকাল শনিবার দুপুরে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের বিশেষ সাংগঠনিক সভায় ঢাকা বিভাগের জেলা/মহানগর নেতারা এসব অভিযোগ তোলেন। রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা বিভাগের প্রায় প্রতিটি জেলার নেতারাই উপরোল্লিখিত অভিযোগ তুলেছেন।
কেউ কেউ তাদের বক্তব্যে পরোক্ষভাবে তাদের জেলার কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদেরও সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত সংসদ সদস্যরা (এমপি) এমন আচরণ করেন, তাতে করে মনে হয় দলটা বুঝি এমপিদের। অথচ শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত এমপিরা দলের, এমপিদের দল আওয়ামী লীগ নয়।
এমপিদের বিষয়ে পরোক্ষ অভিযোগ তুলে ধরে জেলার নেতৃবৃন্দ জানান, প্রভাবশালীদের কারণে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা যাচ্ছে না। এ সময় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেন জেলার নেতারা।
তাদের ভাষ্যÑ তৃণমূলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে যৌক্তিক কোনো কারণে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া বা বহিষ্কারের সুপারিশ পাঠানো হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা সহজে এর বিহিত করেন না; কোনো রেসপন্স তারা পান না। রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর হাকিম বলেন, যারা সংগঠনবিরোধী কাজ করে,ন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছি।
কিন্তু এগুলোর ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী এমদাদুল হক বলেন, সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ আরও একটি সংগঠনের কমিটি সম্মেলন করা হয়েছে। বাকিদের কমিটি কেন্দ্র থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এই সংগঠনগুলো নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়। এই কমিটির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্র।
আরেকটি সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগে ঢোকার যোগ্যতা নাই, নিয়মে নাই; বিভিন্ন সময় তাদের দিয়ে কেন্দ্র থেকে এ কমিটিগুলো করে দেওয়া হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত তুলে ধরে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, ঘাটাইল ও ভুয়াপুরে কমিটি আমরা করতে পারিনি। এই সংকট থেকে আমাদের মুক্তি দিতে হবে।
আমরা আপনাদের নিয়েই এ সমস্যা সমাধান করতে চাই। তিনি বলেন, আমাদের আরও কিছু সমস্যা আছে, যা এখানে বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় আপনারা সবাই বিজ্ঞ মানুষ, আপনারা সবই জানেন। কারণ আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী কেরামত আলী বলেন, আমি সহযোগী সংগঠনের বিষয়ে একটি কথা বলতে চাই। যা নিয়ে আমরা খুবই সমস্যার মধ্যে রয়েছি।
আমাদের এখানে যুবলীগ ১৪ বছর ধরে আহ্বায়ক কমিটিতে চলছে। আবার ডিও লেটারের মাধ্যমে কমিটি দেওয়া হয়। ডিও লেটারের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কমিটি হলে খুবই খারাপ হয়। শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, আমাদের এখানে সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা ভালো না। আরও অনেক কথা আছে, প্রকাশ্যে বলা যায় না।
আমাদের এভাবে মাঝেমধ্যে ডাকলে আমরা আমাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বলতে পারব। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, তৃণমূল প্রশাসন এমপি-মন্ত্রীদের বেশি গুরুত্ব দেয়; আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দকে সেভাবে দেয় না। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা বা নির্দেশনা দেওয়া যায় কি, তা ভেবে দেখতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানাই।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের এখানে যুব মহিলা লীগ ও কৃষক লীগ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। যারা কোনো দিনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, বরং দলের ও স্বাধীনতার বিরোধী, তাদের পরিবারের সদস্যদের সহযোগী সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঞ্চালনায় সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মারুফা আক্তার পপি, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের বলেন, দলের মধ্যকার কলহ দূর করতে হবে। আওয়ামী লীগ যেন আওয়ামী লীগের শত্রু না হয়। জেলা পর্যায়ে সিনিয়র নেতা যারা আছেন, তারা বসে দলের মধ্যকার এসব কলহের সমাধান করতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। সাধারণ সম্পাদক আগামী ২৩ জুন দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও বঙ্গবন্ধুর জš§শতবার্ষিকীর কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করতে নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
সভায় ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের ডেটা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রের কাছে পাঠাতে জেলা পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।